সুন্দরবনের ভয়ানক সৌন্দর্য

 


সুন্দরবনের ভয়ানক সৌন্দর্য

 

                                                         

ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যঃ

সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি এটি তার অসামান্য জীববৈচিত্র্যের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এই বন বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ প্রাণীর আশ্রয়স্থল। সুন্দরবন বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা বাগেরহাট জেলায় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে অবস্থিত। এর মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যার প্রায় ,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান (World Heritage Site) হিসেবে ঘোষণা করে। এটি রামসার এলাকা হিসেবেও স্বীকৃত, যা একটি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। সুন্দরবন একটি জটিল প্রাকৃতিক ব্যবস্থা, যেখানে নদী, খাল এবং ম্যানগ্রোভ গাছের এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। অসংখ্য ছোট ছোট নদী, খাল এবং খাঁড়ি দ্বারা এটি বিভক্ত। বঙ্গোপসাগরের নোনা পানি এবং গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা থেকে আসা মিঠাপানির মিলনস্থলে এটি গড়ে উঠেছে। জোয়ার-ভাটার প্রভাবে এখানকার পরিবেশ নিয়মিত পরিবর্তিত হয়, যা এখানকার উদ্ভিদ প্রাণীদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত সুন্দরবন তার অপূর্ব জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত


জীববৈচিত্র্যঃ

প্রাণীসম্পদঃ সুন্দরবনের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাণী হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার যা বিশ্বের বিরল প্রজাতির বাঘের মধ্যে অন্যতম। সুন্দরবন বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন যেখানে বাঘ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রায় ১২৫টি বাঘ রয়েছে ( সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে )(সর্বশেষ ২০২৩২০২৪ সালের ক্যামেরা ট্র্যাপিং জরিপ অনুযায়ী,) এরা জলেও সাঁতার কাটতে পারে। এছাড়াও এখানে দেখা যায় চিত্রা হরিণ, নোনা পানির কুমির, শুশুক বা ডলফিন (ইরাবতী ডলফিন সহ), বানর এবং বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। সুন্দরবনে প্রায় ২৬০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ  মাছরাঙা (Alcedinidae), পানকৌড়ি (Phalacrocoracidae), বক (Ardeidae), ঈগল (Accipitridae) ইত্যাদি

উদ্ভিদজগতঃ সুন্দরবনের গাছপালা লবণাক্ত পানিতে বেঁচে থাকার জন্য অভিযোজিত হয়েছে। এখানকার প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি হলো Heritiera fomes বা সুন্দরী গাছ (এই গাছের নাম থেকেই 'সুন্দরবন' নামটির উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়) এছাড়াও কেওড়া, গোলপাতা, গেওয়া, গরান, বাইন, ধুন্দুল, হেঁতাল, ইত্যাদি গাছগুলো এখানে প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। এই গাছগুলোর শ্বাসমূল (pneumatophores) লবণাক্ত পানিতে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে এটি ম্যানগ্রোভ বনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এই বনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছ রয়েছে। 

পরিবেশগত গুরুত্বঃ

সুন্দরবন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। জলোচ্ছ্বাস এবং উপকূলীয় ক্ষয় থেকে দেশকে রক্ষা করে। ম্যানগ্রোভ বনের গাছপালা মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং উপকূলীয় এলাকার পরিবেশকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও, এই বন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এটি উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার জন্য অপরিহার্য, কারণ এখান থেকে কাঠ, মধু, মোম এবং বিভিন্ন ধরনের মাছ সংগ্রহ করা হয়।  

 

বিপদ সংকটঃ        

মানব আগ্রাসন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের কারণে সুন্দরবন আজ হুমকির মুখে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘন ঘন ঝড় বা ঘূর্ণিঝড় (উল্লেখযোগ্য ঘূর্ণিঝড়সমূহ:

ভোলা সাইক্লোন (১৯৭০): বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়, যা আনুমানিক থেকে লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। (১৯৭০ ভোলা ঘূর্ণিঝড় - উইকিপিডিয়া )

সিডর (২০০৭): ঘণ্টায় ২৬০ কিমি বেগে আঘাত হানে, আনুমানিক ,৪৪৭১৫,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।

আম্পান (২০২০): ১৭টি উপকূলীয় জেলায় ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে, ৩১ জনের মৃত্যু হয়।

 রেমাল (২০২৪): . মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ২০ জনের মৃত্যু ঘটে, এবং ৩৫,০০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।)

এসব ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের অস্তিত্বের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে। তারপর  নির্বিচারে গাছ কাটা, চোরা শিকারিদের তৎপরতা, বনের ভেতরে জাহাজ চলাচল এবং কল-কারখানার বর্জ্য তেল নদীতে ছড়িয়ে পড়া, সুন্দরবনের পরিবেশ জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিও সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি। এসব কারণে অনেক মূল্যবান প্রাণী উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। তবে মানুষ যেমন বনের জন্য হুমকি, তেমনি বন্যপ্রাণীর আক্রমণেও প্রতিবছর কিছু মানুষের মৃত্যু ঘটে

  

জীবিকাঃ

সুন্দরবনের আশপাশে লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে, যাদের জীবিকা বননির্ভর ---মাছ ধরা, চিংড়ি চাষ, মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ, (এপ্রিল-মে মাসে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করে,) গোলপাতা কাঠ সংগ্রহ প্রভৃতি।

সংরক্ষণ প্রচেষ্টাঃ

বাংলাদেশ ভারত সরকার সুন্দরবনকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউনেস্কো, ডব্লিউডব্লিউএফ এবং অন্যান্য সংস্থা সংরক্ষণে কাজ করছে। বাংলাদেশে এটি তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত: পূর্ব, পশ্চিম দক্ষিণ অভয়ারণ্য। বাঘের আক্রমণ কমাতে গ্রামবাসীদের মুখোশ বৈদ্যুতিক বেড়া ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বাঘের সংখ্যা জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণে ক্যামেরা ট্র্যাপ জরিপ ব্যবহৃত হচ্ছে।

পর্যটন তথ্য

পর্যটন : সুন্দরবন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। বাংলাদেশে খুলনা, মোংলা দুবলার চর থেকে ট্যুর পরিচালিত হয়। জনপ্রিয় স্থানগুলো হলো হিরণ পয়েন্ট, কটকা, কচিখালী, দুবলার চর।

কীভাবে যাবেন: বাংলাদেশ থেকে খুলনা বা মোংলা হয়ে লঞ্চ বা ট্রলারে সুন্দরবন যাওয়া যায়। ভারতে সাগর দ্বীপ বা ক্যানিং থেকে প্রবেশ করা যায়।

দেখার সময়: নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, শীতকালেই পর্যটনের জন্য উপযুক্ত সময়, যখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকে এবং বন্যপ্রাণী দেখা সহজ হয়

সতর্কতা: পর্যটকদের বনের নিয়ম মানতে হয়, যেমন শব্দ না করা, বন্যপ্রাণীকে বিরক্ত না করা।

উপসংহারঃ

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের এক অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যার সংরক্ষণ আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব বন পরিবেশ রক্ষায় যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এটি সংরক্ষণ করা অপরিহার্য সুন্দরবন যদি টিকে থাকে, তবে টিকে থাকবে আমাদের প্রাকৃতিক পরিচয়, পরিবেশগত সুরক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আশা সুন্দরবন শুধু একটি বন নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রাকৃতিক প্রহরী পরিবেশগত নিরাপত্তার এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান

🌐 Drifture — যেখানে প্রযুক্তিভাবনা  অনুভূতি একসঙ্গে পথ চলে

 Writer: Drifture (Abu Bokor)

📅 Published: JUNE 2025

🔗 www.drifture.com

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post